22 C
Chittagong
মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩
প্রচ্ছদস্বাস্থ্যসরকারি হাসপাতালে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ইন্টার্নশিপ!

সরকারি হাসপাতালে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ইন্টার্নশিপ!

  মো.সাহাবু উদ্দিন

কোনো যাচাইবাছাই ছাড়াই চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পাচ্ছে ভুয়া মেডিকেল কোর্স পরিচালনা কারী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। অবৈধ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত নার্সিং, প্যারামেডিকেল, ফার্মেসী, ডিএমএস ও এলএমএএফ কোর্সের ছাত্র-ছাত্রীদের অর্থের বিনিময়ে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ করে দিচ্ছে মুনাফালোভী একটি চক্র।

খোদ জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. শেখ ফজলে রাব্বির স্বাক্ষর করা একটি অনুমোদন পত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে না থাকা ‘ডিপ্লোমা ইন কমিউনিটি প্যারামেডিক কোর্স’ নামের কথিত কোর্সধারী শিক্ষার্থীদেরও ইন্টার্নশিপ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চালু না থাকা এমন কোর্সধারীদের সরকারি হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ দেওয়াকে অনৈতিক ও বেআইনি বলে মন্তব্য করেছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা.মো.মহিউদ্দিন।

যদিও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান ‍পরিচালনা করার সুযোগ নেই। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নশিপ করতে চাইলে সেখানেও আমাদের অনুমোদন নিতে হয়। জয়েন স্টক অনুমোদন দিয়ে মেডিকেল কোর্স পরিচালনা করারও সুযোগ নেই। তাছাড়া নার্সিং কোর্সগুলো নার্সিং কাউন্সিলের অধীনে পরিচালিত হয়।

ইন্টার্নশিপের জন্য অনুমোদন পাওয়া ভুয়া ‍প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো- ওএইচএস মেডিকেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, যুব উন্নয়ন মেডিকেল ইনস্টিটিউট ও সিএইচডিএস মেডিকেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠান তিনটির নার্সিং কোর্স পরিচালনা করার কোনো ধরনের অনুমোদন না থাকলেও তারা নার্সিং কোর্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোর্স পরিচালনা করে আসছে।

এর আগে সিএইচডিএস মেডিকেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ে ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো ক্লিক নিউজ বিডি। ধারাবাহিক অনুসন্ধানে কেঁচো খুড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে সাপ। জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসব অবৈধ ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে অবগত থাকার পরও ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে।

জানা গেছে, শুধু জয়েন স্টক থেকে সোসাইটির অনুমোদন নিয়ে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং ও বিভিন্ন কারিগরি কোর্স পরিচালনা করছে এসব প্রতিষ্ঠান। ডিপ্লোমা ইন নার্সিং কোর্স ও নার্সিংয়ের শর্ট কোর্স পরিচালনা করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকা থাকলেও তোয়াক্কা করছে না প্রতিষ্ঠান গুলো। এসব ভুয়া মেডিকেল ট্রেনিং সেন্টার প্রকাশ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুইটি বিভাগ রয়েছে- একটি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ও আরেকটি স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সেবা সংক্রান্ত বিষয় দেখাশুনা করলেও শিক্ষা বিভাগের কোনো অফিস চট্টগ্রামে না থাকায় এসব বিষয় ঢাকা থেকে দেখভাল করা হয়। সে সুযোগটি কাজে লাগিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্রটি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা জয়েন স্টক থেকে নেওয়া ‘আওয়ার হোপ সোসাইটি’ নামের একটি সোসাইটির অনুমোদন নিয়ে চট্টগ্রাম ও বিভিন্ন উপজেলায় ১৮ টি শাখা খুলে মেডিকেল ট্রেনিং সেন্টার পরিচালনা করেছে ওএইচএস নামের একটি মেডিকেল ট্রেনিং সেন্টার। দিচ্ছে নাসিং, প্যারামেডিকেল, ডি.এম.এস, এল.এম.এ.এফ, আর.এম.পি ও মা ও শিশু স্বাস্থ্য (এমসিএইচ) ওপর সার্টিফিকেট। প্রতিটি কোর্স ফি বাবদ নেওয়া হচ্ছে ৬ হাজার টাকা থেকে ১৮ হাজার টাকা। কোর্স শেষে দেওয়া হচ্ছে নিজেদের তৈরি করা মানহীন সার্টিফিকেট। এসব ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে শিক্ষার্থীরা কাজ করছে বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে।

জানতে চাইলে ওএইচএস মেডিকেল ইনস্টিটিউটের বহদ্দারহাট ব্রাঞ্চের পরিচালক মেহরাজ হোসেন বলেন, আমাদের ওএইচএস এ যারা নাসিং ও প্যারামেডিকেল কোর্স করবে তারা কোর্স শেষে চট্টগ্রাম সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করার সুয়োগ পাবে। তবে ইন্টার্নশিপ করার জন্য প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ৬ হাজার টাকা করে দিতে হয়। কোর্স ফি’র পরও ইন্টার্নশিপের জন্য কেন ৬ হাজার টাকা দিতে হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি স্টুডেন্টের জন্য আমাদেরকে জেনারেল হাসপাতালে টাকা দিতে হয়। টাকা ছাড়া জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করা যায় না’।

এদিকে নগরীর চকবাজারের চকসুপার মার্কেটের ৩য় তলায় যুব উন্নয়ন মেডিকেল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠানটি কক্সবাজারের একটি ‍প্রতিষ্ঠানের কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে নেওয়া অনুমোদনের নাম্বার ব্যবহার করে চলছে। যদিও ২০২০ সাল থেকে মেডিকেল বিভাগের সকল কোর্স স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করেছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যুব উন্নয়ন কম্পিউটার এন্ড মেডিকেল ইনস্টিটিউট এর ব্যবহারিত প্রতিষ্ঠান কোডটি কক্সবাজার জেলার। ৭৪০১৬ নং কোডে জেএস কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নামের একটি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত। প্রতিষ্ঠানটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নামে নিবন্ধিত হলেও বেআইনিভাবে চট্টগ্রামে মেডিকেল ইনস্টিটিউট পরিচালনা করছে তারা ।

এ বিষয়ে জনতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা রাসেল সরকার বলেন, আমাদের যুব উন্নয়ন কম্পিউটার এন্ড মেডিকেল ইনস্টিটিউটের ২ বছর মেয়াদের কোর্সগুলো পরিচালিত হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে, ১ বছরের কোর্সগুলো বাংলাদেশ টেকনিক্যাল বোর্ডের আন্ডারে এবং ১ বছরের কিছু কোর্স চিকিৎসক অনুষধের অধীনে। আমাদের এখানে কোর্স শেষে সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ইর্ন্টার্নি করার সুযোগ রয়েছে।

তিনি আরও জানান, জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নি করার জন্য আলাদা টাকা দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানটির কি ধরণের অনুমোদন রয়েছে জানতে চাইলে তিনি প্রতিষ্ঠানটির মালিক চকবাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর মোস্তাফা টিনুর সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। তাদের চট্টগ্রাম এবং চকোরিয়ায় শাখা রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। তবে প্রতিষ্ঠানটির কোনো ‍বৈধ অনুমোদনের কপি দেখাতে পারেননি প্রতিবেদককে।

এ বিষয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর মোস্তাফা টিনুর সাথে যোগাযোগ করা হলে এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, যুব উন্নয়ন মেডিকেল ইনস্টিটিউট নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার সম্পৃক্ততা নেই। যদি কেউ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সাথে আমি জড়িত আছি এ ধরনের ভুয়া তথ্য দিয়ে থাকে আপনি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেন। প্রয়োজনে আইন আদালতে আমি সাক্ষি দিব। আমি কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে মানুষের সেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করার সময় আমার নেই।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কম্পিউটার অপারেটর লতিফা আনজুম পপি জানান, জেনারেল হাসপাতালে যুব উন্নয়নের ৩৫ জন শিক্ষার্থী ইন্টার্নশিপ করছে। ইন্টার্নশিপের আবেদনের সময় তারা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের একটি অনুমোদনের কপি জমা দিয়েছেন।

ইন্টার্নশিপ নিয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা আমাদের হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করতে চাইলে আমরা তাদের ব্যাপারে ‍অনাপত্তিপত্র দিয়ে থাকি। পরে সেটা পরিচালক চিকিৎসা শিক্ষা বরাবর ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানে তাঁরা প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র যাচাই করে অনুমোদন দিলে আমরা ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ দিই। তবে এসব কাগজ পত্র আমরা যাচাই করি না।

সিএস/জেইউএস

সর্বশেষ