
চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৬ টিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জালের মতো বেশ কয়েকটি শাখা খুলে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং, সার্টিফিকেট ইন মেডিক্যাল টেকনোলোজি,প্যারামেডিকেল, ফিজিওথেরাপি, রেডিওলোজি, প্যাথলজি, ডেন্টাল, ফার্মেসি, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট, এলএমএফ ও ডিএমএস সহ নানান বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সিএইচডিএস মেডিকেল ট্রেনিং সেন্টার নামের একটি স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব ট্রেনিং স্বাচ্ছন্দে চালিয়ে যাওয়াসহ প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা- এই তিন মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি সনদ জালিয়াতি করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। শুধু তাই নয়-এসব জাল সনদ জমা দিয়ে সরকারি একটি হাসপাতালে ২৬ জন শিক্ষার্থীকে ইন্টার্নশিপও করিয়েছে সিএইচডিএস।
ক্লিক নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে সিএইচডিএস’র জাল-জালিয়াতির এসব তথ্য বেরিয়ে এলেও জালিয়াতির বিষয়টি অস্বীকার করেন সিএইচডিএস’র পরিচালক রিয়াদ রহমান। তিনি জোরগলাতেই বলেন, সিএইচডিএস প্রতিষ্ঠানটি কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে অনুমোদন প্রাপ্ত। তার প্রতিষ্ঠানের সমস্ত সার্টিফিকেট তিনি নিজেই দেন। কোনো মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয় না এবং তার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন দরকার নাই বলেও জানান তিনি। তবে তার প্রতিষ্ঠানের কি ধরণের অনুমোদন রয়েছে তা প্রতিবেদককে দেখাতে অস্বীকৃতি জানান।
সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভুয়া অনুমোদনের কাগজ তৈরি করে ডিপ্লোমা ইন নাসিং ও সার্টিফিকেট ইন মেডিক্যাল টেকনোলোজি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সিএইচডিএস মেডিকেল ট্রেনিং সেন্টার নামের প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১ সালে নগরীতে এই ট্রেনিং সেন্টার চালুর পর থেকে পাঁচ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি হয়েছে বলে জানা গেছে। কোনো ধরনের অনুমোদন না থাকলেও শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে ১ বছর ও ২ বছর মেয়াদের ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট ও প্রশিক্ষণ সনদ। যদিও এসব সনদ ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের কোনো কাজে আসবেনা বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ক্লিক নিউজ বিডি’র হাতে আসা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. শাহ নেওয়াজের স্বাক্ষরিত একটি অনুমোদপত্র (তারিখ ২৫/২/২০২১ ইংরেজি, স্বারক নং-স্বাঃঅধিঃপ্রশাঃ/বিবিধ সার্কুলার/২১২/২০২১) দেখার পর অনুমোদনপত্রটি জাল বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াস চৌধুরী। অনুমোদনপত্রে স্বারকের লিখার ধরণ ও একই পত্রে এক ব্যক্তির দুই ধরনের স্বাক্ষর হওয়ায় এই মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন আগেও সাক্ষর জালিয়াতি করার অভিযোগে আমরা একজনকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি এবং তার বিরুদ্ধে মামলাও রুজু করা হয়েছে।
২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসনের অনুমোদন পত্রে সিভিল সার্জন চট্টগ্রামকে অনুলিপি পাঠানোর কথা উল্লেখ থাকলেও সে অনুলিপি পাঠানো হয়নি বলে জানান সিভিল সার্জন চট্টগ্রামের সহকারি শাহেদুল ইসলাম।
২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড পরিচালক (কারিকুলাম) মোঃ আব্দুর রেজ্জাক স্বাক্ষরিত প্রাথমিক পাঠদানের একটি অনুমতি পত্র যার স্বারক নং বাকাশিবো/ ক (স্বাঃপ্রঃ)/২০২১/৪৫৭। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন মোঃ আব্দুর রেজ্জাক।
২০১৪ সালে সরকারি চাকরি থেকে মোঃ আব্দুর রেজ্জাক অবসর গ্রহণ করলে ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি এই অনুমতি পত্রে স্বাক্ষর করেন কি করে? এমন প্রশ্ন করে খোদ বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তা।
ক্লিক নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিএইচডিএসকে দেওয়া বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের এই অনুমোতি পত্রটিও জাল। এর আগে ২০১১ সালে ১৬ আগস্ট ‘গ্লোবাল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের একটি অনুমোদন পত্র স্বাক্ষর করেন সে সময়ে দায়িত্বরত পরিচালক (কারিকুলাম) মোঃ আব্দুর রেজ্জাক। যার স্বারক নং বাকাশিবো/ক (স্বাঃপ্রঃ)/২০১১/৪৫৭।
২০১১ সালে ১৬ আগস্ট সেই অনুমোদন পত্রের স্বাক্ষর জাল করে এই অনুমোদন পত্র তৈরি করে সিএইচডিএস। অনুমোদন পত্রটির স্বারক নম্বরে শেষের তিনটি অক্ষর একই থাকলেও শুধু বদলানো হয়েছে সাল।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সিএইচডিএসকে দেওয়া বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অনুমোদন পত্রটি ২০২১ সালে দেওয়া হলেও ২০২০ সাল থেকে এসব কারিকুলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করেছে কারিগরি শিক্ষাবোর্ড।
২০২০ সালের পর এই ধরণের শিক্ষা কারিকুলামের কোনো অনুমতি কারিগরি শিক্ষাবোর্ড দেয়না বলে নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ (শর্ট কোর্স) আব্দুর রাজ্জাক মিয়া। তিনি বলেন, এটা আমাদের কোনো অনুমোদন নয়। এছাড়া ২০২০ সালের পর বোর্ড কোনো মেডিকেল প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয় নাই। কারণ মেডিকেল বিভাগ বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়াও একই আদেশে কখনোই সার্টিফিকেট ইন মেডিকেল টেকনোলোজি এবং ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলোজি কোর্স অনুমোদন হয় না। মোঃ আব্দুর রেজ্জাক অনেক আগেই সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন বলেও নিশ্চিত করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, যারা এ ধরণের প্রতারণা করছে তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
সিএইচডিএসের অনুমতিপত্রটি জাল বলে নিজেই স্বীকারোক্তি দেন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের তৎকালিন (২০১১ সাল) পরিচালক (কারিকুলাম) মোঃ আব্দুর রেজ্জাক। তিনি বলেন, আমি অবসরে গেছি অনেক আগে। সিএইচডিএস’র অনুমতি পত্রটি ভুয়া। মোঃ আব্দুর রেজ্জাক’র স্বীকারোক্তির একটি অডিও রেকর্ড ক্লিক নিউজ বিডি’র কাছে সংরক্ষিত আছে।
অপরদিকে প্রতিষ্ঠানটির প্রসপেক্টাস ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে জমা দেওয়া কাগজপত্রে ব্যবহৃত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের (জয়েন স্টক কোম্পানি নিবন্ধন নং ৫২৮১৯) নিবন্ধন নম্বরটিতে সিএইচডিএস নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে সনদটিতে থাকা বার কোডটি স্ক্যান করলে সোসাইটি অফ ওয়াল্ড হিউম্যান রাইটস ভিশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নাম আসে। যা নিবদ্ধিত হয় ১৮ নভেম্বর ২০২০ সালে আর জয়েন স্টক কোম্পানি নিবন্ধন নং এস-১৩৪৫৬।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিএইচডি ট্রেনিং সেন্টারের মালিক রিয়াদ রহমান নিজেকে চার বছরের ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারি পরিচয় দেন এবং নিজেই পরিচালনা করেন ডিপ্লোমা কোর্স। যদিও ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনা করার জন্য সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যবাদকতা থাকলেও তিনি তা না মেনে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের একটি ভুয়া অনুমোদন পত্র বানিয়ে তা দিয়ে ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল টেকনোলজি ও সার্টিফিকেট ইন মেডিকেল টেকনোলজি কোর্স পরিচালনা করে আসছে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রছাত্রীদের ইর্ন্টানশীপ করার জন্য জমা দেওয়া একটি আবেদনপত্র থেকে সংগ্রহ করা একটি অনুমোদনের কপিতে দেখা যায় ডিপ্লোমা কোর্স এবং সার্টিফিকেট কোর্স পরিচালনার জন্য কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের একই কর্মকর্তা অনুমোদন দিয়েছেন। যা কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের কারিকুলামের সাথে সামঞ্জস্য নয়।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সিএইচডিএস মেডিকেল ট্রেনিং সেন্টারে প্যারামেডিকেল, ফিজিওথেরাপি, রেডিওলজী, ডি.এম.এস (ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল সায়েন্স ), ডেন্টাল, প্যাথোলজি, ফার্মেসি, ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট এর ওপর ১ বছর ও ২ বছর মেয়াদের ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট্ দেওয়া হয় । এছাড়াও দেওয়া হয় এলএমএফ, আরএমপি ও মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ওপর ৪ মাস ও ৬ মাস মেয়াদি বিভিন্ন সার্টিফিকেট। যদিও এসব ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনা করার জন্য এমবিবিএস ডিগ্রিধারী হওয়ার শর্ত থাকলেও তিনি তা না মেনে তিনি নিজেই প্রশিক্ষণ দেন। ফেসবুকে সিএইচডিএসের পেইজে পোষ্ট করা বিভিন্ন ছবি ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির রাহাত্তারপুল ব্রাঞ্চে সরেজমিন গিয়ে কথা বলে জানা যায়, ১ বছর ও ২ বছরের প্যারামেডিকেল কোর্সের সার্টিফিকেট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়। যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেখা যাবে বলে জানান সেখানে দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি। তিনি আরো জানান, আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রাপ্ত তাই আমাদের সব সার্টিফিকেট এসএসসি ও এইচএসসির মতো সরকারি ওয়েবসাইটে দেখা যাবে। তবে যাদের বয়স ৫০ বছর তাদের সার্টিফিকেট সিএইচডিএস থেকে দেওয়া হয়। কারণ বয়স ৫০ বছরের বেশি হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের এলাও করে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন)’র অনুমোদন ও কারিগরি বোর্ডের অনুমোদনপত্র জাল তৈরি করার বিষয়ে জানতে চাইলে রিয়াদ রহমান বলেন, আমি ১০ জনের মতো ব্যবসা করছি। যদি আমি কোনো সনদ জাল করে থাকি কারিগরি বোর্ড আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে এবং আমার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিবে কোনো সমস্যা নেই।
ভুয়া সনদে সিএইচডিএস’র শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, মাঠ পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। কোনো প্রতিষ্ঠান ভুয়া অনুমোদনপত্র তৈরি করে থাকলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সিএইচডিএস’র বিষয়টি আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এই সম্পকৃত আরও সংবাদ:
সিএস